অশ্রুপাতের সময় ছিলো না
মনির জামান
যুদ্ধের শুরুটা ছিল কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক প্রাদেশিক জনগণের উপর জাতিগত নিধন।
এই নিষ্ঠুরতা শুরু করে আয়ুব খান; পঞ্চাশের দশকে বালুচদের নির্বিচার হত্যার মধ্য দিয়ে।
৭১ সালে ইয়াহিয়া একই পথ বেছে নেয় বাঙালিদের সর্বশান্ত করে দেওয়ার জন্য।
মনে রাখা দরকার, সেনাবাহিনীও পরিচালিত হয় কোন না কোনো গোষ্ঠীস্বার্থে।
কেন্দ্রীয় সরকারের প্রদেশে প্রদেশে গনহত্যার কীবা প্রয়োজন ছিল? কার স্বার্থরক্ষার জন্য এই আগ্রাসন?
এর একটাই উত্তর–পাঞ্জাবিদের সামনে রেখে ভারত থেকে বিতাড়িত মুসলিম রিফুজিগোষ্ঠীর পুনর্বাসনের জন্য এই নিধনযজ্ঞ প্রয়োজন হয়ে পড়ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের; জাতি পরিচয় এবং উদ্বাস্ত পরিচয়ের দ্বন্দ্ব মিমাংসার জন্য। এখন যা নিষ্পত্তি হয়েছে ‘বাংলাদেশী’ নামে।
পাকিস্তান নামে কোনো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বৃটিশ-ভারতের মানচিত্রে ছিল না।
এরা হিন্দুদের তাড়িয়ে আমাদের জাতিগত পরিচয় ভুলিয়ে দিয়ে সবাইকে উর্দুঅলা বানিয়ে পুরো পাকিস্তানে রিফুজিদের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল।
একারণে এই স্বার্থগোষ্ঠী কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনী দিয়ে প্রত্যন্ত রাঙ্গুনিয়ার গহীনগ্রামে ঢুকে জুমার নামাজ আদায়করা নিরস্ত্র তৈয়ব চাচাকে হত্যা করতে দ্বিধা করে না।
তার অপরাধ, যুদ্ধভয়ে ত্রস্ত কয়েকটি পরিবারকে সে আশ্রয় দিয়েছিল।
সৈনিকরা চলে যাওয়ার পর পুরোগ্রাম হামলে পড়ে তালুকদার বাড়িতে।
তৈয়ব চাচার মা ‘আঁর পুত আঁর পুত’ বলে বুক চাপরিয়ে বিলাপ করে। চাচী উঠানের উপর গড়াগড়ি যায়।
দুই শিশুপুত্র আমাদের সঙ্গে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
রক্ত গড়িয়ে সিড়ি পযর্ন্ত নেমে আসে। সবার সামনে দাপাতে দাপাতে মরে যায় তৈয়ব চাচা।
এই মৃত্যু; এমন নিষ্ঠুরতা একজীবনে ভুলবার নয়।
কিন্তু সময় ছিল ভয়াবহ। চোখের জল চেপে রেখে সন্ধ্যা ঘনাতে না ঘনাতে সবাই মিলে এই মহৎপ্রান মানুষটিকে কবরে শুইয়ে দেয়।
আব্বা এসে বলে–তোমরা তৈরি হয়ে নাও। এখনি বেরুতে হবে।
ঊত্তীর্ণ সন্ধ্যায় আমরা তালুকদার বাড়ি ছেড়ে গাঢ় অন্ধকার পথে কর্ণফুলির তীরে এসে দাঁড়াই।
আলাউদ্দিন চাচা বলে–দেরি করিয়েন না, ভাবী; নৌকায় ওঠেন।
আমি জানতে চাই–আব্বা কই?
আছে। পরে আসবে।
আমরা নদীর বুকে ভেসে চলি। কোথায় যাবো, জানিনা।
এমন দুঃখের মধ্যেও তৈয়ব চাচী একটা বিছানার চাদর দিয়েছিলেন; আম্মা যা বহুবছর আলমারিতে রেখে মাঝে মাঝে মিলাদের সময় ব্যবহার করেছেন। #
(চলবে…)